বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচিতি

Image
Image

বিশ্ববিদ্যালয় পরিচিতি

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকালে স্বাধীন জাতিসত্ত্বার বিকাশের লক্ষ্যে বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়। ব্রিটিশ ভারতে তৎকালীন শাসকদের অন্যায্য সিদ্ধান্তে পূর্ববঙ্গের মানুষের প্রতিবাদের ফসল হচ্ছে এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এ সম্পর্কে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী গ্রন্থে লিখেছেন,

বঙ্গভঙ্গ রদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। লর্ড লিটন যাকে বলেছিলেন স্প্লেনডিড ইম্পিরিয়াল কমপেনসেশন। পূর্ববঙ্গ শিক্ষাদীক্ষা, অর্থনীতি সব ক্ষেত্রেই পিছিয়ে ছিল। বঙ্গভঙ্গ হওয়ার পর এ অবস্থার খানিকটা পরিবর্তন হয়েছিল, বিশেষ করে শিক্ষার ক্ষেত্রে।[১৪]

১৯১২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ। এর মাত্র তিন দিন পূর্বে ভাইসরয় এর সাথে সাক্ষাৎ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আবেদন জানিয়ে ছিলেন ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, ধনবাড়ীর নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরীশেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক এবং অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। ২৭ মে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তাব করেন ব্যারিস্টার আর. নাথানের নেতৃত্বে ডি আর কুলচার, নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, নওয়াব সিরাজুল ইসলাম, ঢাকার প্রভাবশালী নাগরিক আনন্দচন্দ্র রায়, জগন্নাথ কলেজ (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়)-এর অধ্যক্ষ ললিত মোহন চট্টোপাধ্যায়ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ ডব্লিউ.এ.টি. আচির্বল্ডঢাকা মোহসিনীয়া মাদ্রাসার (বর্তমান কবি নজরুল সরকারি কলেজ) তত্ত্বাবধায়ক শামসুল উলামা আবু নসর মুহম্মদ ওয়াহেদ, মোহাম্মদ আলী (আলীগড়), প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষ এইচ. এইচ. আর. জেমস, প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক সি.ডব্লিউ. পিক, এবং সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ সতীশচন্দ্র আচার্য। ১৯১৩ সালে প্রকাশিত হয় নাথান কমিটির ইতিবাচক রিপোর্ট এবং সে বছরই ডিসেম্বর মাসে সেটি অনুমোদিত হয়। ১৯১৭ সালে গঠিত স্যাডলার কমিশনও ইতিবাচক প্রস্তাব দিলে ১৯২০ সালের ১৩ মার্চ ভারতীয় আইন সভা পাশ করে 'দি ঢাকা ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট (অ্যাক্ট নং-১৩) ১৯২০'। লর্ড রোনাল্ডসে ১৯১৭ হতে ১৯২২ সাল পর্যন্ত বাংলার গভর্নর থাকা কালে সৈয়দ শামসুল হুদা কে বিশ্ববিদ্যালয়ের আজীবন সদস্য ঘোষণা করেন। সৈয়দ শামসুল হুদার সুপারিশে স্যার এ. এফ. রাহমান কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভোস্ট মনোনীত করা হয়, তিনি ইতঃপূর্বে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে কার্যরত ছিলেন।[১৫] পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে রফিকুল ইসলামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮০ বছর গ্রন্থ থেকে জানা যায়, নাথান কমিটি রমনা অঞ্চলে ৪৫০ একর জায়গায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রস্তাব দেয়। এই জায়গায় তখন ছিল ঢাকা কলেজগভর্নমেন্ট হাউস, সেক্রেটারিয়েট ও গভর্নমেন্ট প্রেসসমূহ।

সৃষ্টির শুরুতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নানা প্রতিকূলতার মুখে পড়ে। এ ছাড়া ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। এর ফলে পূর্ব বাংলার মানুষ হতাশা প্রকাশ করে। ১৯১৭ সালের মার্চ মাসে সাম্রাজ্যিক বিধান পরিষদে সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী সরকারের কাছে অবিলম্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিল পেশের আহ্বান জানান। ১৯২০ সালের ২৩ মার্চ গভর্নর জেনারেল এ বিলে সম্মতি দেন। এ আইনটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার ভিত্তি। এ আইনের বাস্তবায়নের ফলাফল হিসেবে ১৯২১ সালের ১ জুলাই ৮৭৭ জন শিক্ষার্থী নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে [১৬]। এ ৮৭৭ জনের মধ্যে নারী ছিলেন একজন।[১৭]

ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বার উন্মুক্ত হয় ১৯২১ সালের ১ জুলাই। সে সময়ের ঢাকার সবচেয়ে অভিজাত ও সৌন্দর্যমণ্ডিত রমনা এলাকায় প্রায় ৬০০ একর জমির উপর পূর্ববঙ্গ এবং আসাম প্রদেশের পরিত্যক্ত ভবনাদি এবং ঢাকা কলেজের (বর্তমান কার্জন হল) ভবনসমূহের সমন্বয়ে মনোরম পরিবেশে গড়ে উঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার এই দিনটি প্রতিবছর "ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস" হিসেবে পালন করা হয়।

তিনটি অনুষদ ও ১২টি বিভাগ নিয়ে একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এর যাত্রা শুরু হয়। ঢাকা কলেজ ও জগন্নাথ কলেজের (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) ডিগ্রি ক্লাসে অধ্যয়নরত ছাত্রদের নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে। শুধু ছাত্র নয়, শিক্ষক এবং লাইব্রেরির বই ও অন্যান্য উপকরণ দিয়েও এই দুটি কলেজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করে। এই সহযোগিতা দানের কৃতজ্ঞতা হিসেবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’টি হলের নামকরণ করা হয় ঢাকা হল (বর্তমানে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হল) ও জগন্নাথ হল[১৮]

কলা, বিজ্ঞান ও আইন অনুষদের অন্তর্ভুক্ত ছিল সংস্কৃত ও বাংলা, ইংরেজি, শিক্ষাইতিহাসআরবিইসলামি অধ্যয়ন, ফার্সি ও উর্দু, দর্শনঅর্থনীতি ও রাজনীতিপদার্থবিদ্যারসায়নগণিত এবং আইন

প্রথম শিক্ষাবর্ষে বিভিন্ন বিভাগে মোট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল ৮৭৭ জন এবং শিক্ষক সংখ্যা ছিল মাত্র ৬০ জন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী লীলা নাগ (ইংরেজি বিভাগ; এমএ-১৯২৩)। যে সব প্রথীতযশা শিক্ষাবিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্নে শিক্ষকতার সাথে জড়িত ছিলেন তারা হলেনঃ হরপ্রসাদ শাস্ত্রীএফ.সি. টার্নারমুহম্মদ শহীদুল্লাহজি.এইচ. ল্যাংলিহরিদাস ভট্টাচার্যডব্লিউ.এ.জেনকিন্সরমেশচন্দ্র মজুমদারস্যার এ. এফ. রাহমানসত্যেন্দ্রনাথ বসুনরেশচন্দ্র সেনগুপ্তজ্ঞানচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন অস্থিরতা ও ভারত বিভক্তি আন্দোলনের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রযাত্রা কিছুটা ব্যাহত হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুইটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। তৎকালীন পূর্ববঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত প্রদেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে এ দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা উজ্জীবিত হয়। নতুন উদ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ড শুরু হয়। তৎকালীন পূর্ববাংলার ৫৫ টি কলেজ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয়। ১৯৪৭-৭১ সময়ের মধ্যে ৫টি নতুন অনুষদ, ১৬টি নতুন বিভাগ ও ৪টি ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে গৌরবময় ভূমিকা। স্বাধীনতা যুদ্ধে এ বিশ্ববিদ্যালয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণের শিকার হয়। এতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ছাত্র-ছাত্রী সহ অনেকে শহীদ হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীদের কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখার লক্ষ্যে ১৯৬১ সালে স্বৈরাচারী আইয়ুব খানের সরকার প্রবর্তিত অধ্যাদেশ বাতিলের জন্য ষাটের দশক থেকে শিক্ষকদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীনতার পর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ উক্ত অধ্যাদেশ বাতিল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডার-১৯৭৩ জারি করে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয় এই অর্ডার দ্বারা পরিচালিত হয়ে আসছে।